ফুটবল নিয়ে ৮ টি আশার গুড়ে বালি

মাইকেল কক্স

২০০০ সালে ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিন নতুন শতাব্দীকে স্বাগত জানাতে ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের এক সাক্ষাৎকার নেয়। সেখানে তাকে ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়— “আগামী একশ বছরে ফুটবলে কী ঘটবে বলে মনে করেন?”

ব্লাটার হাসতে-হাসতে উত্তর দেন, “একশ বছর পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে আমি ২৫ বছর পর্যন্ত ভাবতে পারি।”

“আমি মনে করি, এই সময়ে কোনো বড় পরিবর্তন হবে না,” বলেছিলেন ব্লাটার।

আসলেই কিছু হয়নি।

ব্লাটার হয়তো ভবিষ্যৎ নিয়ে বাড়তি অনুমান না করে বুদ্ধিমানের কাজই করেছিলেন। কারণ, সে সময়ের প্রচলিত ধারণাগুলোর অনেকগুলোই ২৫ বছর পর এসে পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ফুটবলের যেসব দিক নিয়ে সবাই একমত ছিল—সেগুলোর অনেকটাই অন্য পথে গিয়েছে। ২১-শ শতকের যে ভবিষ্যৎ চিত্র আমরা ভেবেছিলাম, তার অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি—অন্তত এখনো না।

‘ইউরোপ-দক্ষিণ আমেরিকার যুগল আধিপত্য ভাঙবে’

যে সাক্ষাৎকারে ব্লাটার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করেননি, সেখানেই তিনি নিজের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বলেছিলেন—ফুটবলকে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার একচেটিয়া আধিপত্য থেকে বের করে আনা। ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপে দলসংখ্যা ২৪ থেকে ৩২ করার ফলে অন্য মহাদেশের আরও দল সুযোগ পেয়েছিল।

কিন্তু ফুটবলের পরাশক্তিগুলো এখন ‘বাইরের’ দেশগুলোর দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে—এই ধারণা আসলে তা একপ্রকার মিথ। আগামী বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাব্য নয়টি ফেভারিট দল (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, পর্তুগাল—এই সাতটি ইউরোপ থেকে; আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল—দক্ষিণ আমেরিকা থেকে) ঠিক এই একই নয়টি দলই ছিল ২০০৬ সালের টুর্নামেন্টের আগেও।

পরবর্তী সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বুকমেকারদের তালিকায় আছে বেলজিয়াম ও উরুগুয়ে—দুটোই ছোট দেশ, তবু সেই একই দুই মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে ‘চমকপ্রদ পার্টি স্পয়লার’ ছিল ক্রোয়েশিয়া—আবারও ইউরোপীয় দেশ—যারা ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপে যথাক্রমে রানার- আপ ও তৃতীয় স্থান পেয়েছে। কিন্তু তারা ১৯৯৮ তেও তৃতীয় হয়েছিল; তাই এটাকে নতুন শতাব্দীর অর্জন বলা যাবে না।

অথচ আমরা আরও ভিন্ন কিছু আশা করেছিলাম।

‘আফ্রিকার উত্থান ঘটবে’

পুরুষদের অলিম্পিক ফুটবল টুর্নামেন্ট সাধারণত খুব নজরকাড়া নয়, কিন্তু ১৯৯৬ এ নাইজেরিয়ার স্বর্ণজয় এবং চার বছর পর ক্যামেরুনের সাফল্য ইঙ্গিত দিয়েছিল যে আফ্রিকান দেশগুলো বিশ্বমঞ্চে বড় শক্তি হয়ে উঠছে। কিংবদন্তি পেলে একসময় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন—নতুন শতাব্দীর শুরুতেই কোনো আফ্রিকান দেশ বিশ্বকাপ জিতবে। এটি শুধু পেলেই বলেননি, তখনকার ইংল্যান্ড ম্যানেজার ওয়াল্টার উইন্টারবটমও ১৯৬২ সালেই একই কথা বলেছিলেন।

আফ্রিকা অবশেষে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে উঠল ২০২২ সালে, মরক্কো সবাইকে চমকে দিয়ে শেষ চার পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে তাদের ২৬ জনের দলে ১৪ জনই জন্মেছেন দেশের বাইরে—বেশিরভাগই পশ্চিম ইউরোপে। এটি মরক্কোর অর্জনকে কমিয়ে দেয় না, কিন্তু ফুটবলে পশ্চিম ইউরোপীয় আধিপত্য কমে আসছে—এমনটাও বোঝায় নয়। তাছাড়া এভাবে দল গঠন করা অন্য আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য সহজে অনুসরণযোগ্যও নয়।

স্বীকার করতেই হয়, ২০২২ বিশ্বকাপ আফ্রিকার জন্য ভালো গেছে—আংশিকভাবে কাতারে বিপুল সমর্থকের উপস্থিতির কারণে। আর মহাদেশটির সম্ভাবনার স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৬ সালের ৪৮ দলের বিশ্বকাপে তারাই বড় উপকারভোগী। কিন্তু নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন—এমনকি ঘানা বা আইভরি কোস্টও—যেভাবে নিয়মিত প্রতিদ্বন্দ্বী হবে ভেবেছিলাম, তা হয়নি।

ইউরোপ-দক্ষিণ আমেরিকার বাইরে অন্য সেমিফাইনালিস্ট দল বলতে দক্ষিণ কোরিয়ার কথা আসে, যারা ২০০২ সালে নিজ মাটিতে অনেকটা বিতর্কিত রেফারিংয়ের সাহায্যে এগিয়েছিল। তারপর থেকে তারা পাঁচটি বিশ্বকাপে একবারের বেশি ম্যাচ জিততে পারেনি। অন্যান্য ‘আউটসাইডার’—অস্ট্রেলিয়া, ঘানা, জাপান, মেক্সিকো, সেনেগাল—তারা বিভিন্ন সময়ে ভালো খেলোয়াড় পেয়েছে, কিন্তু কোনো দলই স্থায়ীভাবে এলিট স্তরে পৌঁছায়নি।

তবে এটিও সত্য, নারী ফুটবলে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য কিছুটা বেশি। তারপরেও ২০২৩ সালের সর্বশেষ নারী বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো শীর্ষ তিনটি দলই এসেছে ইউরোপ থেকে।

‘লন্ডনের ক্লাবগুলো শহরের বাইরে চলে যাবে — এবং মাঠ ভাগাভাগি করবে’

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

আজকের দিনে কেউ যদি ইউরোপের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলো সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করে, তাহলে সেখানকার সবচেয়ে বড় ভ্রান্ত ধারণাগুলোর একটি হলো এই— ২০শ শতকের শেষে অনেকেই ভাবত, শহরের ভেতরে ফুটবল ক্লাব রাখা একদিন আর সম্ভব হবে না।

তখনকার যুক্তি ছিল—

লন্ডন বা ম্যানচেস্টারের মতো শহরে জমির দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ফুটবল মাঠ রক্ষণাবেক্ষণও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। তাই ক্লাবগুলো ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে উপশহর বা বাইরে চলে যাবে—যেমনটি দেখা গেছে কিছু আমেরিকান স্পোর্টস ফ্র্যাঞ্চাইজিতে।

বেশ কিছু সংবাদপত্র এমনকি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল—“লন্ডনের বড় দলগুলো একসময় একই মাঠ ভাগাভাগি করে খেলবে।”
টটেনহ্যাম ও আর্সেনালের মধ্যে একসময় এমন ভাবনাও এসেছিল, ২০০০ সালের দিকে স্টেডিয়াম পুনর্নির্মাণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায়।

কিন্তু বাস্তবে কী হলো?

হয়তো ছোট ছোট কিছু ক্লাব শহরের উপকণ্ঠে চলে গেছে, কিন্তু বড় ক্লাবগুলো বরং নিজস্ব ঐতিহ্যের মাটিতেই থেকে গেছে এবং সেটিকেই আধুনিক করে তুলেছে।

  • আর্সেনাল হাইবুরি ছেড়ে গেলেও শহরেই নতুন এমিরেটস স্টেডিয়াম তৈরি করল—পুরোনো এলাকার সাথেই সংযুক্ত।
  • টটেনহ্যাম তাদের ঐতিহাসিক হোয়াইট হার্ট লেন ধ্বংস করেও ঠিক একই জায়গায় নতুন স্টেডিয়াম গড়েছে।
  • চেলসি এখনো স্ট্যামফোর্ড ব্রিজেই খেলছে, যদিও তারা নতুন করে সেটি পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা করছে।
  • ওয়েস্ট হ্যাম স্থানান্তরিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা “লন্ডনের বাইরে” নয়—বরং শহরের আরেক অংশে, অলিম্পিক পার্কে।

লন্ডনের ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে প্রকৃতি, গণপরিবহনের সহজলভ্যতা, আর ক্লাবগুলোর ঐতিহাসিক পরিচয়—সব মিলিয়ে এটি সম্ভব করেছে।
আজকালকার ফুটবলে যেখানে ব্র্যান্ড ও ইতিহাসই ক্লাবের মূল সম্পদ, সেখানে শহরের কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়া মানে নিজেদের আত্মপরিচয় হারানো।

আর মাঠ ভাগাভাগি?

এখনো পর্যন্ত ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর মধ্যে সেটি কার্যত অসম্ভব।
সমর্থকদের কাছে তাদের স্টেডিয়াম একধরনের আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের সঙ্গে একই মাঠ ভাগাভাগি করার ধারণা আজও একপ্রকার নিন্দনীয়।

উদাহরণ হিসেবে ইতালির মিলান শহরে ইন্টার ও এসি মিলান এখনো সান সিরো ভাগাভাগি করে—কিন্তু এটিও পরিবর্তনের পথে।
দুই ক্লাবই ঘোষণা করেছে তারা নিজস্ব নতুন স্টেডিয়াম বানাবে, আলাদা করে।

অর্থাৎ ২৫ বছর পর এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি—
ফুটবল ক্লাবগুলো শহরের বাইরে চলে যাওয়ার পরিবর্তে বরং নিজেদের স্থানীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাস আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছে।

‘ইউরোপীয় সুপার লিগ হবে — এবং সেটা টিকে থাকবে’

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

ফুটবলের ব্যবসায়িক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত দুই দশকে ক্লাব ফুটবল একরকম বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে টেলিভিশন সম্প্রচার, স্পনসরশিপ আর চ্যাম্পিয়নস লিগের জনপ্রিয়তা একসাথে মিলে ইউরোপীয় ক্লাবগুলোকে বিপুল অর্থ এনে দেয়।

এই প্রেক্ষাপটে তখন থেকেই অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন —
“শিগগিরই একটি ইউরোপীয় সুপার লিগ তৈরি হবে, যেখানে কেবল ধনী ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলো অংশ নেবে — এবং সেটিই হবে ফুটবলের ভবিষ্যৎ।”

এই ধারণা মোটেও নতুন ছিল না। ১৯৯০-এর দশকেই এমন প্রস্তাব উঠেছিল, যা উয়েফা (UEFA) পরে সামাল দেয় চ্যাম্পিয়নস লিগের কাঠামো বাড়িয়ে।
তবু ধারণাটা থেকেই যায় — ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ক্লাবগুলো একত্রিত হয়ে নিজেদের আলাদা প্রতিযোগিতা করবে, যাতে তারা প্রতিবার একে অপরের সঙ্গে খেলতে পারে, আর আয়ও ভাগাভাগি করতে পারে।

২০২১ সালে, মহামারির ঠিক পরপরই, ১২টি বড় ইউরোপীয় ক্লাব মিলে সেই ইউরোপীয় সুপার লিগ প্রকল্পটি ঘোষণা করে।
সেই তালিকায় ছিল রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, জুভেন্টাস, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল, টটেনহ্যাম, ইন্টার, এসি মিলান ও আতলেতিকো মাদ্রিদ।

কিন্তু এই ঘোষণার পরেই ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
ভক্তরা, সাংবাদিকরা, এমনকি নিজেদের খেলোয়াড়রাও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
তারা মনে করেছিল—এই লিগ “অর্থলোভী মালিকদের পরিকল্পনা”, যা ফুটবলের আত্মাকে হত্যা করবে

মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই প্রকল্পটি ভেঙে পড়ে।
ইংল্যান্ডের ছয়টি ক্লাব সবার আগে সরে দাঁড়ায়, এবং তাদের পিছু নেয় অন্যরাও।
শেষ পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও জুভেন্টাস কাগজে-কলমে টিকে থাকলেও, প্রকল্পটি বাস্তবে মৃতই থেকে যায়।

কেন টেকেনি এই লিগ?

মূল কারণ — ফুটবল আর শুধু ধনী মালিকদের পণ্য নয়;
এটি এখনো মানুষের সংস্কৃতি, আবেগ আর স্থানীয় পরিচয়ের প্রতীক।

সুপার লিগের কাঠামোটি ছিল “বন্ধ”, অর্থাৎ কোনো দল পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে উঠে আসতে পারবে না।
এটি ভক্তদের কাছে ফুটবলের মৌলিক প্রতিযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে গিয়েছিল।

এই আন্দোলন প্রমাণ করল,
সমর্থকদের চাপ এখনো এতটাই শক্তিশালী যে, তারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ক্লাব মালিকদের সিদ্ধান্তও বদলে দিতে পারে।

তবে…

সুপার লিগের ধারণা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।
রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা এখনো প্রকাশ্যে বলছে — তারা বিশ্বাস করে, একদিন এই লিগ ফিরবে, “আরও ন্যায্য কাঠামোয়।”
অন্যদিকে, উয়েফাও নিজের চ্যাম্পিয়নস লিগে সংস্কার এনেছে—
নতুন “সুইস মডেল” অনুসারে ২০২৪-২৫ মৌসুম থেকে দলসংখ্যা ও ম্যাচ বাড়ানো হয়েছে, যাতে আরও বেশি আয় নিশ্চিত করা যায়।

অর্থাৎ, ব্লাটারের সময়ে যেমন ভাবা হয়েছিল—“একটা স্থায়ী ইউরোপীয় সুপার লিগ ফুটবলের ভবিষ্যৎ হবে”—
বাস্তবে আমরা পেয়েছি তার এক নরম সংস্করণ, যেখানে চ্যাম্পিয়নস লিগই আসলে সেই সুপার লিগের রূপ নিয়েছে, শুধু নামটা আলাদা।

‘ফুটবল বোরিং হয়ে যাবে’

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

১৯৯০-এর দশকে অনেক বিশ্লেষক মনে করতেন, ফুটবলের “স্বর্ণযুগ” পেরিয়ে গেছে।
তাদের যুক্তি ছিল—

  • খেলোয়াড়রা এখন বেশি অ্যাথলেটিক,
  • রক্ষণাত্মক কৌশল বাড়ছে,
  • আর ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা কমে যাচ্ছে।

ফলে ফুটবল ধীরে ধীরে হবে “একঘেয়ে, সাজানো এবং পূর্বানুমেয়”।

সেই সময়ের বিশ্বকাপ (ফ্রান্স ৯৮, ইউরো ২০০০) দেখেও এমন ধারণা জোরদার হয়েছিল।
গোল কম, রক্ষণ বেশি, আর ম্যাচগুলো প্রায়ই অতিরিক্ত সময় বা পেনাল্টিতে গড়াচ্ছে।
এমনকি কিছু পণ্ডিত বলেছিলেন,

“ফুটবল তার বিনোদনমূলক শক্তি হারাচ্ছে — টিভির যুগে এটি টিকে থাকতে চাইলে নিয়ম পরিবর্তন দরকার।”

কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক উল্টোটা।

নতুন শতাব্দীতে ফুটবল হয়ে উঠেছে আরও দ্রুত, আরও প্রযুক্তিনির্ভর এবং অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন।
ট্যাকটিক্যালভাবে খেলাটি বদলে গেছে।

  • পেপ গার্দিওলা, ইউর্গেন ক্লপ, কার্লো আনচেলত্তি, জোসে মরিনহো — এই প্রজন্মের কোচরা ফুটবলের কৌশলগত চিত্রটাই পাল্টে দিয়েছেন।
  • “টিকি-টাকা”, “গেগেনপ্রেসিং”, “হাই লাইন”, “ইনভার্টেড ফুলব্যাক” — এসব ধারণা এখন ফুটবলের মূল অংশ।
  • ম্যাচগুলো এখন গড়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি গোলসমৃদ্ধ, গতি অনেক বেশি, আর টিভি সম্প্রচারও দর্শকদের জন্য অনেক প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা তৈরি করছে।

প্রযুক্তির প্রভাব

VAR (ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি) নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটি খেলার মধ্যে এক নতুন স্তরের উত্তেজনা ও বিশ্লেষণ যোগ করেছে।
তাছাড়া ড্রোন-ক্যামেরা, ট্র্যাকিং ডেটা, ও ইনস্ট্যান্ট রিপ্লে প্রযুক্তি ফুটবল দেখাকে আজকের দিনে আরও সিনেমাটিক করে তুলেছে।

টেলিভিশন সম্প্রচার এখন একপ্রকার চলচ্চিত্রের মতো সাজানো হয়—
স্লো-মোশন, একাধিক কোণ, গ্যালারির প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে এটি দর্শকের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা।

ক্লাব ফুটবলের নাটকীয়তা

আর যদি কেউ বলে “ফুটবল এখন বোরিং”—তবে শুধু গত দশকের ম্যাচগুলো মনে করলেই বুঝবেন কতটা উল্টোটা সত্য।

  • ২০১৭ সালে বার্সেলোনা বনাম পিএসজি — ৬-১ এর অবিশ্বাস্য কামব্যাক।
  • ২০১৯ সালে লিভারপুল বনাম বার্সেলোনা — অ্যানফিল্ডের ইতিহাস গড়া রাত।
  • ২০২২ সালে ম্যানচেস্টার সিটি বনাম রিয়াল মাদ্রিদ — শেষ মুহূর্তে দুই গোলের মহাবিস্ময়।
  • বিশ্বকাপের ক্ষেত্রেও — ২০১৪-র “ব্রাজিল ১–৭ জার্মানি”, কিংবা ২০২২-এর আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স ফাইনাল—
    এসব ম্যাচ ফুটবলকে নাটকের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

ফুটবল তাই শুধু “খেলা” নয়, বরং আজকের দিনে একটি মহাকাব্যিক গল্প বলার মাধ্যম

একঘেয়েমি নয়, বরং বৈচিত্র্য বেড়েছে

২০০০ সালের আগে ফুটবলে রক্ষণাত্মক দলগুলো প্রাধান্য পেত।
কিন্তু এখন আক্রমণাত্মক ফুটবলই নতুন মানদণ্ড।

  • ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে প্রতি মৌসুমে গড় গোলসংখ্যা বেড়েছে।
  • চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা একঘেয়ে ফাইনাল নেই; প্রত্যেক মৌসুমে নতুন গল্প, নতুন নায়ক।
  • ছোট দলও বড় দলকে হারাতে পারছে — যেমন লেস্টার সিটির ২০১৬ সালের শিরোপা জয় ইতিহাসে অনন্য।

সব মিলিয়ে, ব্লাটার বা সেই সময়ের বিশ্লেষকদের ধারণার বিপরীতে,
ফুটবল এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুততর, বুদ্ধিদীপ্ত এবং বিনোদনমূলক।

ফুটবলে অর্থের প্রভাব — ধনীরা আরও ধনী, গরিবরা আরও গরিব

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

২০০০ সালের আশেপাশে ফুটবল অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ভবিষ্যদ্বাণী ছিল।
অনেকে বিশ্বাস করতেন—
টেলিভিশন সম্প্রচার, বিজ্ঞাপন ও গ্লোবালাইজেশনের ফলে অর্থের প্রবাহ ফুটবলকে আরও সমতাভিত্তিক করে তুলবে
ছোট ক্লাবও সুযোগ পাবে বড়দের মতো আয় করার, এবং প্রতিযোগিতা আরও ভারসাম্যপূর্ণ হবে।

কিন্তু ২৫ বছর পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি— বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো।

বড় ক্লাব আরও বড় হয়েছে

২০০০ সালে “বিগ ক্লাব” মানে ছিল রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ, মিলান, জুভেন্টাস।
আজও সেই তালিকা প্রায় একই।

তারা শুধু নিজেদের ফুটবল মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে—

  • কোটি কোটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনুসারী,
  • বিশ্বব্যাপী মার্চেন্ডাইজ বিক্রি,
  • স্পনসরশিপ ও ট্যুর আয়,
  • এমনকি নিজেদের টেলিভিশন চ্যানেল ও মিডিয়া নেটওয়ার্ক।

এদিকে, মধ্যম সারির ক্লাবগুলো ক্রমশ পিছিয়ে গেছে।
ইংল্যান্ডের উদাহরণ নিন — ১৯৯৫ সালে ব্ল্যাকবার্ন রোভার্স প্রিমিয়ার লিগ জিতেছিল, কিন্তু আজ তারা দ্বিতীয় সারির লিগে।
ইউরোপের অন্যত্রও একই চিত্র — পার্থক্য ক্রমশ বেড়েছে।

“সুপার ক্লাব” ধারণার উত্থান

এই সময়ে “সুপার ক্লাব” ধারণা তৈরি হয়েছে।
এরা শুধু ফুটবল ক্লাব নয় — বহুজাতিক বিনোদন প্রতিষ্ঠান।

ম্যানচেস্টার সিটি, প্যারিস সেন্ট জার্মেইন, নিউক্যাসল ইউনাইটেড —
সবাই এখন এমন রাষ্ট্র বা কনগ্লোমারেটের মালিকানাধীন, যাদের মূল পুঁজি ফুটবলের বাইরের শিল্প থেকে আসে —
তেল, প্রযুক্তি, মিডিয়া বা রিয়েল এস্টেট।

এই আর্থিক শক্তিই আজ তাদের প্রতিযোগিতায় অপ্রতিরোধ্য করেছে।

“ফাইনান্সিয়াল ফেয়ার প্লে” — এক অসম্পূর্ণ চেষ্টা

২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে উয়েফা চেষ্টা করেছিল এক ধরনের আর্থিক ভারসাম্য আনতে—
“ফাইনান্সিয়াল ফেয়ার প্লে” (FFP)।
লক্ষ্য ছিল—

ক্লাবগুলো যেন তাদের আয়ের সীমার মধ্যে খরচ করে, যাতে কেউ অতি ধনী মালিকের কারণে অন্যদের ছাপিয়ে যেতে না পারে।

কিন্তু বাস্তবে এই নিয়ম বড় ক্লাবদের আরও সুবিধা দিয়েছে।
কারণ তাদের আয়, স্পনসরশিপ ও ভিউয়ারশিপ এতটাই বেশি যে ছোট ক্লাব কখনোই তাদের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না।
অর্থাৎ, অসাম্যই নিয়ম হয়ে গেছে।

স্থানীয় থেকে বৈশ্বিক

আগে ক্লাব মানে ছিল এক শহরের গর্ব, এক সম্প্রদায়ের প্রতীক।
এখন ক্লাবগুলো “গ্লোবাল ব্র্যান্ড”।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত এখন ঢাকাতেও, নাইরোবিতেও, টোকিওতেও।
যদিও এর মানে ক্লাবগুলো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে,
তবে তাদের স্থানীয় পরিচয় বা “কমিউনিটি সংযোগ” অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে।

ট্রান্সফার মার্কেটের পাগলামি

২০০০ সালে ফিগোর ৩৭ মিলিয়ন ইউরোর রিয়াল মাদ্রিদে স্থানান্তর ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা।
আজ ১০০ মিলিয়নের নিচে বড় ট্রান্সফার খবরে আসে না।

২০২৩ সালে এনরিক, কেইন, বেলিংহাম, এমবাপে, ডিক্লান রাইস —
সবাই ১০০–১৫০ মিলিয়ন ইউরোতে স্থানান্তরিত হয়েছে।

এই ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের ধারাই প্রমাণ করে—
ফুটবলে অর্থই এখন চূড়ান্ত শক্তি।

তবে উল্টো দিকও আছে

অর্থের বন্যা একদিকে ফুটবলের বৈষম্য বাড়িয়েছে,
অন্যদিকে কিছু নতুন সুযোগও তৈরি করেছে।

  • ছোট ক্লাব এখন বিশ্বের যে কোনো জায়গা থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে নিতে পারে।
  • নতুন মালিকেরা নতুন অবকাঠামো, ট্রেনিং ফ্যাসিলিটি ও একাডেমি গড়ে তুলছেন।
  • নারীদের ফুটবলেও বিনিয়োগ বাড়ছে, যা এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

তবুও, বলা যায়—
ফুটবলে অর্থনৈতিক ব্যবধান এখনো সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।

ট্যাকটিক্যাল বিপ্লব ও খেলার গতি পরিবর্তন

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

২০০০ সালের দিকে অনেকে ভাবতেন, ফুটবলের গতি হয়তো তার সীমায় পৌঁছে গেছে।
খেলোয়াড়রা তখনই আগের তুলনায় দ্রুততর, ফিটনেস লেভেল চূড়ান্ত পর্যায়ে, আর খেলার টেম্পো এত বেশি ছিল যে, অনেকেই বলেছিলেন—

“ফুটবল এখন তার সর্বোচ্চ গতিতে চলছে — এর চেয়ে দ্রুত আর সম্ভব নয়।”

কিন্তু দুই দশক পর দেখা গেল, এটা কেবল শুরু ছিল।

প্রেসিং ফুটবলের আগমন

২০০০ সালের আগে দলগুলো মূলত বল পজেশন ও পজিশনাল খেলায় মন দিত।
এখন ফুটবল একেবারে উল্টে গেছে—
প্রেসিং বা বল হারানোর সাথে সাথে দ্রুত পুনরুদ্ধারের কৌশলই এখন আধুনিক ফুটবলের কেন্দ্রবিন্দু।

  • ইউর্গেন ক্লপের “গেগেনপ্রেসিং” দর্শন ফুটবলকে বদলে দিয়েছে।
    তিনি বলেছিলেন,

    “Counter-pressing is the best playmaker in the world.”
    (অর্থাৎ, কাউন্টার প্রেসই এখন সবচেয়ে কার্যকর প্লেমেকার।)

  • গার্দিওলার দলগুলো দেখিয়েছে কিভাবে ছোট পাসে বল ধরে রেখে, পুরো মাঠে প্রতিপক্ষকে টেনে এনে, তাদের দুর্বল জায়গায় আঘাত হানা যায়।

আজকের দিনে প্রায় প্রতিটি শীর্ষ দল হাই লাইনে ডিফেন্স সাজায়,
এবং বল হারালে ৫ সেকেন্ডের মধ্যেই সেটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে।

পজিশনাল ফুটবলের সূক্ষ্মতা

২০০০ সালে মিডফিল্ড মানেই ছিল বড় শরীরের, শক্তিশালী খেলোয়াড় — যেমন প্যাট্রিক ভিয়েরা বা রয় কিন।
এখন মিডফিল্ডার মানে — চিন্তাশীল, কৌশলী ও বহুমুখী খেলোয়াড়।

খেলোয়াড়রা এখন একাধিক ভূমিকা পালন করে:

  • ফুলব্যাকরা আক্রমণে উঠে ইনভার্টেড মিডফিল্ডার হয়ে যায়,
  • ফরোয়ার্ডরা পেছনে নেমে প্লেমেকার,
  • সেন্টারব্যাকরা বল বিল্ড-আপে অংশ নেয়।

অর্থাৎ, ফুটবলের প্রতিটি পজিশন এখন “ফ্লুইড”।

খেলার গতি এখন শুধু দৌড় নয়, সিদ্ধান্তের গতি

আগে “গতি” মানে ছিল দৌড়ের স্পিড।
এখন সেটা সিদ্ধান্তের গতি

খেলোয়াড়রা এখন প্রতি সেকেন্ডে অসংখ্য তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে —
কোথায় পাস দেবে, কাকে প্রেস করবে, কখন লাইন ভাঙবে, কখন পিছু হটবে।

এজন্যই দেখা যায় —
একজন লুকা মডরিচ বা কেভিন ডি ব্রুইনার মতো খেলোয়াড় শারীরিকভাবে অতটা দ্রুত না হলেও
তাদের মস্তিষ্কের গতি তাদেরকে আধুনিক ফুটবলের শ্রেষ্ঠদের কাতারে রেখেছে।

ডেটা ও প্রযুক্তির প্রভাব

২০০০ সালে কোচরা কৌশল তৈরি করতেন অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে।
এখন ফুটবল হলো ডেটা-ড্রিভেন সায়েন্স

  • প্রতিটি খেলোয়াড়ের গতি, দৌড়ের দূরত্ব, পাসের কোণ — সবকিছু মাপা হয়।
  • ক্লাবগুলো “এক্সপেক্টেড গোলস” (xG), “প্রগ্রেসিভ পাস”, “প্রেসার রেজিস্ট্যান্স” — এসব সূচক ব্যবহার করে খেলোয়াড় বিশ্লেষণ করে।
  • বড় ক্লাবগুলো এখন ডেটা অ্যানালিস্টদের বিশাল একটা টিম রাখে, যাদের কাজ হচ্ছে প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে বের করা।

এই প্রযুক্তি ও বিশ্লেষণই খেলাকে আরও তীক্ষ্ণ, পরিকল্পিত ও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।

খেলোয়াড়দের বহুমুখিতা

২০০০ সালে একজন ফরোয়ার্ড মানেই গোলস্কোরার।
এখন ফরোয়ার্ডরা খেলাটি তৈরি করতেও সমান দক্ষ।

লিওনেল মেসি, হ্যারি কেন, করিম বেনজেমা —
সবাই “ফলস নাইন” ভূমিকা নিয়ে প্রমাণ করেছেন যে
একজন ফরোয়ার্ড শুধু ফিনিশার নয়, বরং প্লেমেকারও হতে পারে।

এমনকি ডিফেন্ডারদেরও এখন পাসিং স্কিল অপরিহার্য।
ভার্জিল ভ্যান ডাইক বা জন স্টোনস শুধু রক্ষণে নয়, বল বিল্ড-আপেও দল পরিচালনা করে।

মাঠ ছোট হয়নি, কিন্তু সময় কমেছে

ফুটবলের মাঠ এখনো ১০৫x৬৮ মিটার, কিন্তু খেলার স্থানিক ধারণা বদলে গেছে।
একই মাঠে এখন খেলোয়াড়দের “স্পেস” বা জায়গা অনেক কম।
কারণ, প্রেসিংয়ের ফলে প্রতিপক্ষ মুহূর্তেই ঘিরে ফেলে।

এজন্য বলের নিয়ন্ত্রণ, দৃষ্টিশক্তি, ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া
ফুটবলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হয়ে উঠেছে।

ম্যানেজারদের রূপান্তর — খেলোয়াড় থেকে বিজ্ঞানী

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

২০০০ সালের দিকে ফুটবলের ম্যানেজার মানেই ছিল একজন প্রাক্তন খেলোয়াড়,
যিনি অভিজ্ঞতা, প্রবল ক্যারিশমা আর অনুপ্রেরণার মাধ্যমে দলকে চালাতেন।

সেই সময়ের আদর্শ ম্যানেজার ছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বা ফ্যাবিও ক্যাপেলোর মতো মানুষ —
যাঁরা “মানবিক সম্পর্ক” আর “অভিজ্ঞতাজাত সিদ্ধান্তে” বিশ্বাস করতেন।

কিন্তু ২০২৫ সালের ফুটবলে সেই যুগ প্রায় বিলুপ্ত।
এখন ম্যানেজার মানেই একজন বিশ্লেষক, বিজ্ঞানী, ও কৌশলবিদ।

ফুটবল এখন একাডেমিক বিষয়

২০০০ সালে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে “ফুটবল ম্যানেজমেন্ট” পড়ানো হত না।
আজ ইউরোপে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবলের উপর
ডেটা সায়েন্স, কগনিটিভ সাইকোলজি, ও গেম থিওরি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে।

আধুনিক কোচরা কেবল খেলা দেখেন না —
তারা খেলার প্রতিটি মুহূর্তকে ডেটা, জিওমেট্রি ও আচরণবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেন।

নতুন প্রজন্মের কোচ

একটা সময় ক্লাবগুলো বলত — “তুমি যত বড় খেলোয়াড়, তত ভালো কোচ হবে।”
এখন তারা বলে — “তুমি যত ভালো বিশ্লেষক, তত ভালো কোচ হবে।”

সবচেয়ে বড় উদাহরণ:

  • জুলিয়ান নাগেলসম্যান (জার্মানি ম্যানেজার): ২৮ বছর বয়সে কোচিং শুরু করেন, কখনো পেশাদার ফুটবল খেলেননি।
  • রুবেন আমোরিম (স্পোর্টিং লিসবন): ছোট খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার, কিন্তু ট্যাকটিক্যাল জ্ঞানে ইউরোপে এখন তারকা।
  • রবার্টো ডি জারবি (ব্রাইটন): ডেটা ও ট্যাকটিক্সে এতটাই দক্ষ যে তাকে “AI ফুটবলের পথিকৃৎ” বলা হয়।

অর্থাৎ, ফুটবলে এখন বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বই নতুন তারকাখ্যাতি।

টিম এখন “ম্যানেজারের দল” নয়, “ম্যানেজমেন্ট টিম”

আগে ম্যানেজার মানেই সবকিছুর একক সিদ্ধান্তগ্রহীতা।
এখন তিনি শুধু “প্রধান বিশ্লেষক” — তার পাশে থাকে:

  • ট্যাকটিক্যাল অ্যানালিস্ট টিম,
  • স্পোর্টস সায়েন্টিস্ট,
  • ডেটা ইঞ্জিনিয়ার,
  • মনোবিজ্ঞানী ও ঘুম বিশেষজ্ঞ,
  • নিউট্রিশনিস্ট ও রিকভারি বিশেষজ্ঞ।

একটি আধুনিক ক্লাবের স্টাফ টিমে এখন ৫০–১০০ জন পর্যন্ত পেশাদার থাকে।
তারা সবাই একত্রে কাজ করে একটি নির্ভুল সিস্টেম গড়ে তোলে।

ম্যানেজারের ভূমিকা? এই পুরো মেশিনটি সঠিকভাবে চালানো, তথ্য থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া, আর খেলোয়াড়দের মনস্তত্ত্ব সামলানো।

কোচিং ভাষার বিবর্তন

২০০০ সালে ম্যানেজাররা বলতেন—

“Go out there and play with passion!”

২০২৫ সালে তারা বলেন—

“Stay compact between lines, shift diagonally on press trigger.”

অর্থাৎ, ভাষা বদলে গেছে।
কোচরা এখন খেলোয়াড়দের সঙ্গে এমন কৌশলগত ভাষায় কথা বলেন যা একসময় শুধু ভিডিও গেম বা সামরিক কৌশলে দেখা যেত।

প্রযুক্তির ব্যবহার

ম্যানেজাররা এখন AI ও অ্যানালিটিক্স টুল দিয়ে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ও প্রতিপক্ষ বিশ্লেষণ করেন।
কিছু ক্লাবে “ভার্চুয়াল ট্রেনিং এনভায়রনমেন্ট” রয়েছে, যেখানে খেলোয়াড়রা VR হেডসেটে নিজেদের মুভমেন্ট রিভিউ করে।

কিছু দল “AI কোচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট” ব্যবহার করে, যা বলে দেয়—

“এই প্যাটার্নে তোমার দলের প্রেস সঠিকভাবে ট্রিগার হচ্ছে না।”

অর্থাৎ, ম্যানেজারের কৌশল এখন কেবল তার অভিজ্ঞতার নয়, বরং ডেটা ও মেশিন লার্নিংয়ের যৌথ ফসল।

ম্যানেজার = সিইও + সাইকোলজিস্ট + ট্যাকটিশিয়ান

আজকের দিনে সফল ম্যানেজাররা কেবল কোচ নন।
তারা হচ্ছেন:

  • দলের “CEO” — যিনি পুরো সিস্টেম পরিচালনা করেন,
  • “সাইকোলজিস্ট” — যিনি খেলোয়াড়দের মস্তিষ্ক বুঝে উদ্বুদ্ধ করেন,
  • “ট্যাকটিশিয়ান” — যিনি ম্যাচের প্রতিটি সেকেন্ডে পরিকল্পনা তৈরি করেন।

তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এখন ফুটবলের বাইরে গিয়ে সমাজ, প্রযুক্তি, এমনকি মানব আচরণের গবেষণার সঙ্গে মিশে গেছে।

ফুটবল এক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য: বিনিয়োগ, মিডিয়া ও রাজনীতি

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

২০০০ সালে ফুটবল ছিল জনপ্রিয় বিনোদন, কিন্তু আজ এটি ট্রিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি।
ক্লাবগুলো এখন শুধুই দল নয় — তারা হলো ব্র্যান্ড, মিডিয়া কোম্পানি, আর ভূরাজনীতির হাতিয়ার।

বিদেশি বিনিয়োগের দখল

একসময় ক্লাব মানেই ছিল স্থানীয় সম্প্রদায়ের গর্ব।
কিন্তু এখন ইউরোপের বেশিরভাগ বড় ক্লাব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মালিকানায়।

উদাহরণ:

  • ম্যানচেস্টার সিটি → মালিকানায় আবুধাবির বিনিয়োগ সংস্থা (UAE)।
  • প্যারিস সেন্ট জার্মেইন (PSG) → কাতার সরকারের সমর্থিত।
  • নিউক্যাসল ইউনাইটেড → সৌদি আরবের Public Investment Fund-এর মালিকানায়।
  • চেলসিম্যানচেস্টার ইউনাইটেড → আমেরিকান কর্পোরেট গ্রুপগুলোর নিয়ন্ত্রণে।

এই বিনিয়োগগুলো শুধুই অর্থনৈতিক নয় —
এগুলো “স্পোর্টসওয়াশিং” নামের এক নতুন কৌশলের অংশ,
যেখানে রাষ্ট্র ও কর্পোরেশন নিজেদের রাজনৈতিক ইমেজ শুদ্ধ করতে ফুটবল ব্যবহার করে।

মিডিয়ার বিপ্লব

২০০০ সালে ফুটবল সম্প্রচার মানে ছিল টেলিভিশন।
এখন ফুটবল হচ্ছে একটি অনলাইন কনটেন্ট ইকোসিস্টেম

  • ম্যাচ শুধু টিভিতে নয়, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে, শর্ট ভিডিও, সোশ্যাল মিডিয়া ক্লিপে দেখা যায়।
  • ক্লাবগুলো নিজেদের “মিডিয়া কোম্পানি” তৈরি করেছে — যেমন ম্যানচেস্টার সিটির City Studios বা বার্সেলোনার Barça TV+
  • খেলোয়াড়রা নিজেরাই এখন ব্র্যান্ড: ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউবে কোটি কোটি অনুসারী নিয়ে তারা একেকজন চলন্ত মিডিয়া হাব।

অর্থাৎ, ফুটবল আর সংবাদমাধ্যমের বিষয় নয় — বরং নিজেই একটি সংবাদমাধ্যম।

ক্লাব = কর্পোরেট ব্র্যান্ড

আগে ক্লাবের আয় আসত টিকিট বিক্রি ও টিভি রাইটস থেকে।
এখন আয়ের বড় অংশ আসে:

  • ব্র্যান্ড পার্টনারশিপ,
  • মার্চেন্ডাইজিং,
  • স্পনসরশিপ,
  • গ্লোবাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন থেকে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা
এই তিনটি ক্লাব এখন বিশ্বের যেকোনো বহুজাতিক কোম্পানির মতো পরিচালিত হয়।

তাদের আছে নিজস্ব মার্কেট রিসার্চ টিম, পণ্য ডিজাইন টিম, এমনকি সিনেমা প্রোডাকশন ইউনিটও।

ফুটবল ও ভূরাজনীতি

আজ ফুটবল শুধু অর্থনীতির অংশ নয় — এটি কূটনীতির এক রূপ।

  • কাতার ২০২২ বিশ্বকাপের মাধ্যমে নিজেকে বৈশ্বিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
  • সৌদি আরব “Vision 2030” এর অংশ হিসেবে ফুটবলকে ব্যবহার করছে বৈদেশিক ভাবমূর্তি গঠনে।
  • এমনকি চীনের “ফুটবল ড্রিম” নীতি দেখিয়েছে, কিভাবে এক দেশ ফুটবলকে রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক করতে পারে।

ফুটবল এখন কূটনৈতিক সম্পর্ক, বিনিয়োগনীতি ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির অংশ।
এক কথায়, এটি একধরনের “সফট পাওয়ার।”

স্টেডিয়াম = আধুনিক স্মারক

আগে স্টেডিয়াম ছিল ক্লাবের ঘর।
এখন এটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র ও পর্যটন আকর্ষণ।

  • টটেনহ্যামের স্টেডিয়ামে প্রতি সপ্তাহে কনসার্ট, NFL ম্যাচ, এমনকি সিনেমা প্রিমিয়ার হয়।
  • বার্সেলোনার মাঠের নামই বদলে হয়ে গেছে “স্পটিফাই ক্যাম্প ন্যু”, এই স্পন্সরশিপ চুক্তি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডিলগুলোর একটি।
  • স্টেডিয়াম এখন শহরের আইকনিক স্থাপনা,
    যেখান থেকে বছরে শত শত মিলিয়ন ইউরো রাজস্ব আসে।

অসমতা ও বৈষম্য

কিন্তু এই অর্থনৈতিক উত্থান ফুটবলে অসমতা বাড়িয়েছে।

  • বড় ক্লাবগুলো এত ধনী হয়েছে যে ছোট ক্লাবগুলো প্রায় প্রতিযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে।
  • প্রিমিয়ার লিগের আর্থিক শক্তি এখন পুরো ইউরোপের বাকিদের ছাপিয়ে গেছে।
  • ট্রান্সফার ফি এখন এমন পর্যায়ে যে, একজন খেলোয়াড়ের দাম দিয়ে পুরো একটি ক্লাব কেনা যায়।

এমনকি UEFA-এর “ফিনান্সিয়াল ফেয়ার প্লে” নিয়মও এই ধারা ঠেকাতে পারেনি।

প্রযুক্তি ও VAR — মানবীয় খেলার মেশিনভিত্তিক ভবিষ্যৎ

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

একসময় ফুটবল ছিল একেবারে “মানুষের খেলা” —
রেফারির চোখ, খেলোয়াড়ের ইচ্ছা, দর্শকের চিৎকার — এই তিনটাই নির্ধারণ করত ম্যাচের ভাগ্য।
আজ সেই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে মেশিন, ক্যামেরা আর অ্যালগরিদম।

VAR: বিতর্কের নতুন নাম

২০০০ সালের আগে কেউ ভাবতেই পারত না যে একদিন ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (VAR) মাঠের সিদ্ধান্ত পাল্টে দেবে।
তখনকার বিশ্বাস ছিল — “ফুটবল মানে প্রবাহ, থামানো যায় না।”
কিন্তু এখন প্রতিটি গোল, পেনাল্টি, এমনকি অফসাইডও ক্যামেরার চোখে যাচাই হয়।

VAR এসেছে ন্যায়বিচারের নামে,
কিন্তু এনেছে নতুন এক ধরনের বিতর্ক।

  • কেউ বলে এটি খেলাকে ন্যায্য করেছে,
  • আবার কেউ বলে এটি “খেলার আত্মা” নষ্ট করেছে।

এক মুহূর্তের উচ্ছ্বাস এখন প্রায়ই থেমে যায় রেফারির কানে VAR ইয়ারপিসের সংকেতে।
দর্শক গ্যালারিতে আর জানে না — উদযাপন করবে, না অপেক্ষা করবে “চেকিং গোল” ঘোষণার জন্য।

প্রযুক্তির প্রভাব

ফুটবলে প্রযুক্তি এখন সর্বত্র:

  • জিপিএস জার্সি খেলোয়াড়দের গতি ও দূরত্ব মাপে,
  • অ্যানালিটিক্স সফটওয়্যার বলে দেয়, কোন দিক দিয়ে পাস দিলে সম্ভাবনা বেশি,
  • ড্রোন ফুটেজ দিয়ে কোচরা অনুশীলনের প্রতিটি মুভ বিশ্লেষণ করেন।

এমনকি কিছু ক্লাব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করছে প্রতিপক্ষের ট্যাকটিক্স পূর্বাভাসে।

যেমন:

ম্যানচেস্টার সিটি ও লিভারপুল ডেটা অ্যানালিস্ট টিম গঠন করেছে,
যারা প্রতি ম্যাচে কয়েক কোটি তথ্য বিন্দু বিশ্লেষণ করে।

এখন ফুটবল মাঠ মানে শুধু সবুজ ঘাস নয় —
এটি এক বিশাল ডেটা ল্যাবরেটরি

খেলার মানবিক দিক কোথায়?

প্রশ্ন উঠছে —
এই অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর ফুটবলে মানবীয় অনুভূতি কোথায় দাঁড়াবে?

ফুটবল ছিল অনিশ্চয়তার খেলা —
কখনো রেফারির ভুলে নাটক তৈরি হতো, কখনো ভাগ্য বদলাত হঠাৎ এক শটে।

VAR সেই অনিশ্চয়তা কমিয়েছে,
কিন্তু অনেকেই মনে করেন — সেটিই ছিল ফুটবলের সৌন্দর্য।

আর্সেন ওয়েঙ্গার একবার বলেছিলেন,

“ফুটবল ভুলের মধ্যেই বেঁচে থাকে। একে পুরোপুরি নিখুঁত করতে চাওয়া মানে, একে মেরে ফেলা।”

প্রযুক্তি বনাম প্রবৃত্তি

ফুটবলারদের প্রশিক্ষণও এখন প্রযুক্তিনির্ভর।
কিন্তু অভিজ্ঞ কোচদের মতে, প্রযুক্তি সব কিছু মাপতে পারে না —
ইনস্টিংক্ট বা প্রবৃত্তি-ই এখনো খেলাকে চালায়।

একজন মিডফিল্ডারের পাস কখন দিতে হবে,
একজন স্ট্রাইকারের শট কোন মুহূর্তে নিতে হবে —
এই সিদ্ধান্ত কখনো মেশিনে শেখানো যায় না।

পেপ গার্দিওলা যেমন বলেন,

“ডেটা বলে কী হয়েছে, কিন্তু ফুটবলার জানে কী হতে পারে।”

ভক্তদের অভিজ্ঞতা বদলে গেছে

প্রযুক্তি শুধু খেলোয়াড় বা কোচদের নয়,
দর্শকদেরও বদলে দিয়েছে।

  • লাইভ ট্র্যাকিং অ্যাপ এখন বলে দেয় একজন খেলোয়াড়ের স্পিড, টাচ, xG (expected goals)।
  • সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্লেষকরা রিয়েল টাইমে ম্যাচ ভেঙে ফেলেন পরিসংখ্যানে।
  • এমনকি সাধারণ ভক্তরাও এখন “ডেটা এক্সপার্ট” হয়ে উঠছেন।

ফুটবল আর শুধু চোখে দেখা নয় —
এখন এটি “বুঝে দেখা।”

ভবিষ্যতের দিক

আগামী ২৫ বছরে ফুটবল আরও গভীরভাবে প্রযুক্তিনির্ভর হবে:

  • AI কোচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট,
  • হোলোগ্রাফিক রেফারি ট্রেনিং,
  • বায়োমেট্রিক পারফরম্যান্স মনিটরিং,
  • এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ইতিমধ্যেই পরীক্ষাধীন।

কিন্তু একই সঙ্গে, মানবিক অনুভূতি ধরে রাখা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কারণ, ফুটবল যদি একদিন পুরোপুরি মেশিনে চালিত হয়,
তাহলে সেটা “গেম” থাকবে, কিন্তু “খেলা” আর থাকবে না।

ফুটবলের ভবিষ্যৎ — মিথ, বাস্তবতা ও মানবতার লড়াই

(মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত হলো।)

২০০০ সালের শুরুতে, অনেক বিশ্লেষক এবং ক্রীড়া পণ্ডিত মনে করতেন ২১শ শতকে ফুটবল হবে এক নতুন পৃথিবী।
বেশিরভাগ পূর্বাভাস এখন পর্যন্ত ভুল বা অপরিপক্ক প্রমাণিত হয়েছে।

ফুটবল আরও বৈশ্বিক হবে — কিন্তু কি সত্যিই?

একসময় ধারণা করা হত ইউরোপ আর দক্ষিণ আমেরিকার প্রভাব কমবে,
নতুন মহাদেশের দলগুলো বিশ্বকাপের শিরোপার জন্য লড়াই করবে।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন:

  • পরবর্তী বিশ্বকাপের প্রিয় দলগুলো এখনও মূলত ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব।
  • আফ্রিকা ও এশিয়ার দলের সাফল্য sporadic, নিয়মিত নয়।
  • নারী ফুটবলে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য কিছুটা বেশি, কিন্তু পুরুষদের ফুটবল এখনও প্রাধান্য ধরে রেখেছে।

স্টেডিয়াম ও নগরায়ন

২০০০ সালের পূর্বাভাস অনুযায়ী লন্ডনের বড় ক্লাবগুলো শহরের বাইরে চলে যাবে এবং গ্রাউন্ড শেয়ার করবে।
বাস্তবে:

  • Arsenal, Tottenham, Chelsea, অন্যান্য ক্লাবরা শহরের সীমানায়ই থেকেছে।
  • গ্রাউন্ড শেয়ারিং প্রায় অসম্ভব, কারণ ক্লাব নিজস্ব পরিচয় এবং আর্থিক নিরাপত্তা ধরে রাখতে চায়।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে দ্রুত অবসর

এক সময় ধারণা করা হত ক্লাবের জন্য খেলার আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক ফুটবল ত্যাগ করবে।
বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনায় দেখা যায়:

  • মেসি, ইব্রাহিমোভিচ, ক্রোস — যারা আন্তর্জাতিক অবসর নিয়েছিলেন, পরে ফিরেছেন।
  • খেলোয়াড়দের ক্লাব ও দেশ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।

মিডফিল্ড: শক্তি বনাম টেকনিক

২০০০ সালে ধারণা ছিল মিডফিল্ডারদের খেলায় শারীরিকতা হावी হবে, টেকনিক পিছনে পড়বে।
বাস্তবে:

  • গার্দিওলা, পিরলো, মড্রিচের মতো টেকনিকাল মিডফিল্ডাররা আবারও আধিপত্য বজায় রেখেছে।
  • শারীরিকতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, টেকনিক এবং কৌশল এখনও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল

শেষ শতাব্দীর পূর্বাভাসে মনে করা হয়েছিল, ইউএসএ বিশ্ব ফুটবলে শীর্ষে উঠবে।
বাস্তবতা:

  • ইউএসএ গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করেছে, যেমন 2002 সালে কোয়ার্টারফাইনাল।
  • তবে তাদের বিশ্বমানের ফুটবলারের সংখ্যা সীমিত।
  • গোলরক্ষক উৎপাদনও অদ্যাবধি শক্তিশালী নয়।

স্টেডিয়ামের ছাদ ও প্রযুক্তি

২০০০ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, সব বড় স্টেডিয়ামে বন্ধযোগ্য ছাদ থাকবে।
বাস্তবে:

  • শুধুমাত্র কিছু ইউরোপীয় শহরে এটি বাস্তবায়িত হয়েছে (Amsterdam, Madrid, Stockholm)।
  • ইংল্যান্ডে এখনও পুরো ছাদ বা ক্লোজেবল ছাদ নেই।
  • খরচ এবং ব্যবহারিকতা কারণে স্টেডিয়ামের উন্নয়ন সীমিত।

Pay-per-view এবং টেলিভিশন

২০০০ সালে ধারণা করা হয়েছিল, ব্রিটিশ ফুটবল পুরোপুরি Pay-per-view ভিত্তিতে চলে যাবে।
বাস্তবে:

  • প্রায় অসম্ভব প্রমাণিত।
  • Covid-19 সময় সাময়িকভাবে প্রয়োগ হয়েছে, কিন্তু স্থায়ী হয়নি।
  • সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক সম্প্রচারই প্রধান।

প্রাক্তন খেলোয়াড় বনাম নতুন কোচ

অনুমান করা হয়েছিল, ভবিষ্যতের বড় কোচরা প্রাক্তন খেলোয়াড় হবে না।
বাস্তবে:

  • বেশিরভাগ ইউরোপীয় বড় ক্লাবের কোচরা প্রাক্তন খেলোয়াড়।
  • নতুন কোচরা আসলেও, প্রাক্তন খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতা এখনও প্রাধান্য।

শেষ কথা

২৫ বছর আগে ফুটবলকে ঘিরে যে ধারণা ছিল —

  • বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারের উত্থান,
  • প্রযুক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ,
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য,
  • স্টেডিয়াম ও নগরায়নের নাটক,

এগুলোর অনেকটাই ভুল বা খণ্ডিত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

কিন্তু এক জিনিস অপরিবর্তিত:

ফুটবল মানুষের খেলা।
আবেগ, নাটক, অনিশ্চয়তা — এগুলোই এখনও ফুটবলের হৃদয়।

প্রযুক্তি, অর্থনীতি, বৈশ্বিকীকরণ সবই এসেছে,
কিন্তু মানবিকতার ছোঁয়া এখনও ফুটবলকে ফুটবল রেখেছে।

 

মাইকেল কক্স বিশ্বখ্যাত ক্রীড়া লেখক ও বিশ্লেষক। খেলা টিভি ডটকমের পক্ষ থেকে তাঁর এই নিবন্ধটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে হুবুহু অনূদিত হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *